হুমায়ুন আহমেদ : ভালবাসা, পাগলামো নাকি অসুস্থতা?
আব্দুল্লাহ সিফাত তাফসির :
সময়টা ২০০৪ সাল । ১৫ বছরের একটি কিশোর ছেলে কোনভাবেই তার কান্না থামাতে পারছেনা। কেবল মাত্র ছেলেটি একটি বই পড়ে শেষ করেছে । বইটির নাম “আজ আমি কোথাও যাবনা” । সে নিজেকে বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র “জয়নাল” ভাবছে। ছেলেটি নিজেকে ঐ চরিত্র থেকে বের করে আনতে পারছে না। বইটির লেখক হুমায়ুন আহমেদ । তার কিছু দিনের ভেতরেই হুমায়ুন আহমেদ স্যারের অনেকগুলো বই তার পড়া হয়ে গেছে। কিশোর সেই ছেলেটির সমস্ত মস্তিষ্কজুড়ে একটা বিষয়ই কাজ করছে । আর সেটা হল , হলুদ পাঞ্জাবি ও কড়া রোদ এর ভেতর খালি পায়ে হাঁটা আর জ্যোৎস্না। কিশোর সেই ছেলেটি আজ বড় হয়ে গেছে । সে এখন তার অফিসের ডেস্কে বসে এই লেখাটা লিখছে ।
বাইরে এখন মুষূলধারে বৃষ্টি হচ্ছে । আচ্ছা, এই বৃষ্টিতে মিসির আলি সাহেব সাহেব কি করছেন? নিশ্চয়ই তিনি তার মোটা ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়ে কোন না কোন বইয়ের ভেতর ডুবে গেছেন । তিনিতো আবার চিনি ছাড়া চা খতে পছন্দ করেন। হয়তো বইটা থেকে উঠতে ইচ্ছা করছে না বলে তার আর চা খাওয়া হবেনা আজ।
রুপা নিল শাড়িটা পড়ে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে অনেকক্ষন হলো। সে আজ সাজছে। কপালে টিপ দিয়েছে । চোখের কাজল বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে। সেই সাথে কান্নাও। আর হিমু মেসের চৌকিটার উপর আরাম করে শুয়ে আছে আর সিগারেট টানছে আর টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনছে। তার ধারনা আজ টিন ফুটো হয়ে বৃষ্টি তার ঘরে ঢুকবে । ঘটনাটা কখন ঘটে দেখা দরকার। আর আমি বসে আছি অফিসে। বৃষ্টি দেখছি। হুমায়ুন স্যার , আজ আমরা সবাই ছন্নছাড়া। মিসির আলী , মাজেদা খালা, রুপা , রমনা থানার ওসি , মেসের ম্যানেজার , মুরগি সাদেক , আঙ্গুল কাটা জগলু , হিমু এবং আমি, আর আমার মত অনেক অনেক আছে যাদের হিমোগ্লোবিনে আপনি মিশে আছেন আর মিশে আছে আপনার কিছু অমর সৃষ্টি, আর কয়েকটা অমর চরিত্র। আমাদের সবাইকে এক করার ক্ষমতাটি যে মানুষটার হাতে ছিল সে আজ অনুপস্থিত। হুমায়ুন আহমেদ, আপনি অনুপস্থিত।
আমরা সবাই জানি হুমায়ুন আহমেদ স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন । একবার তিনি প্রথম বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস নিচ্ছিলেন । খুব সম্ভত ঐটা স্যারের প্রক্সি ক্লাস ছিল। ক্লাস চলাকালীণ সময় তিনি খেয়াল করলেন যে , একটি ছেলে অনেক বেশি চুপচাপ আর কিছুটা অন্যমনষ্ক । তিনি ছেলেটাকে দাঁড় করালেন আর ছেলেটার নাম জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু ঐ ছেলেটা তার নাম বলছিল না। চুপ করে মাথা নিচু করে ছিল। স্যার কয়েক বার জিজ্ঞাসা করার পরেও ছেলেটা চুপ ছিল , আর স্যার এর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় ছিল। ছেলেটার সহপাঠীরা সবাই হাসছিল। এবার হুমায়ুন স্যার অনেক বিরক্ত হয়ে বললেন , তুমি তোমার নাম কেন বলছোনা ? তখন ছেলেটার পাশে বসে থাকা তার বন্ধুটা বলে উঠলো, স্যার, ওর নাম মিসির আলী। স্যার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে আর কিছু বললেন না। ছেলেটাকে বসতে বললেন । আচ্ছা স্যার , আপনি কি তারপরেও ছেলেটার উপর বিরক্ত ছিলেন ? নাকি প্রাপ্তি আপনাকে আবেগময় করেছিল ? আচ্ছা স্যার, তখন কি আপনার চোখে পানি এসেছিল ? হুমায়ুন স্যার, সফলতা আসলে কি ? আপনি সফল ছিলেন । “মিসির আলী” কে আমরা কল্পনা ভাবতে পারি নাই। “মিসির আলী” আমাদের কাছে বাস্তব ছিল। তাইতো কোন এক বাবা-মা তার সন্তানের নাম রেখেছেন “মিসির আলী”। স্যার, এর নামই বুঝি ভালবাসা।
আরেকবার স্যারকে গুলশান এর এক নামি দামি মানসিক হাসপাতাল থেকে ফোন দিয়ে তাকে হাসপাতালে যেতে বলা হয়। স্যার হাসপাতালে যাবার পর ডাক্তার তাকে বলেন , আপনি কি সব লেখা লেখেন ? আপনার লেখা পড়ে তো মানুষ অসুস্থ হয়ে হয়ে যাবে। এর কারন জানতে চাইলে ডাক্তার বলেন , আমার একজন মেয়ে রুগি আছে যে কিনা আপনার এক বইতে পরেছে , ঢাকা শহরে নাকি পূর্নিমার সময় সব রাস্তা জ্যোৎস্নার আলোতে নদী হয়ে যায়। আর সেই নদীতে নাকি সাঁতার কাটা যায়। কোনো এক পূর্নিমাতে ঐ মেয়ে হলুদ পাঞ্জাবি পরে এয়ারপোর্ট চলে যায়। কাঁটাতার পেরিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে । মাঝরাতে সে নাকি রানওয়ে দিয়ে হেঁটে বেড়াতে থাকে । মেয়েটি এই বিশ্বাস নিয়ে হাঁটছিল যে এই রাস্তা কিছুক্ষন পরে নদী হয়ে আর সেই নদীতে সে সাঁতার কাটবে । ওই মেয়েকে পরে বন্দি করা হয় । মেয়ের মা তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে আসেন । সেই মেয়ে এখন সুস্থ। কাউকে বিশ্বাস করা যদি অসুস্থতা হয়, কাউকে ভালোবাসা যদি অসুস্থতা হয়, তাহলে আমরা যারা হিমুকে ভালবাসি আমরা অসুস্থ। আর আমরা এই অসুস্থতা নিয়েই থাকতে চাই। আমাদের এই অসুস্থতা যিনি দিয়েছেন তাকে ভালবাসতে চাই। আমরা আমাদের এই অসুস্থতা নিয়ে খুশি। হুমায়ুন আহমেদকে ভালবেসে খুশি।
বাকের ভাই এর কথা মনে আছে? বাকের ভাই এর যাতে ফাঁসি না হয় সেজন্য এই দেশে মিছিল বের হয়েছিল। আন্দোলন হয়েছে সেই ফাঁসি আটকানোর জন্য । হুমায়ুন স্যারকে তার নিজ বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এমনকি হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছিল। একটা কাল্পনিক চরিত্রের জন্য আমরা পাগলামি করেছি, আপনি আমাদের পাগল করতে বাধ্য করেছিলেন । একটা কাল্পনিক চরিত্র সাধারন মানুষকে কতটুকু স্পর্শ করলে এটা সম্ভব। সেই অসম্ভবকে কতনা সহজেই করে দেখিয়েছেন আপনি।
মধ্যবিত্ত পরিবারকে নিয়ে আপনি লিখেছেন । মধ্যবিত্ত পরিবারে রববীন্দ্রনাথ , সমরেশ , শীর্ষেন্দুর বই না থাকলেও হুমায়ুন আহমেদের কোন না কোন বই থাকে । আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেতো , তাই হয়তো এভাবে বলতে পারলাম কথাটা । সুশীল সমাজ , সুশীল শ্রেনী বলে আপনি বাজারী লেখক , আপনার লেখা ভালনা। থাক না ঐ সব মানুষের কথা। তাতে কি হয়েছে স্যার ? আপনিতো ওদের জন্য লেখেন নাই , লিখেছেন আমাদের জন্য। আর আমি এবং আমরাতো আপনাকে ভালোবেসেছি , আপনার লেখা পড়ে কেঁদেছি, হেসেছি ।
“জীবন যখন ফুরিয়ে যায় , করুনা ধারায় এসো”-‘আজ হিমুর বিয়ে’ বইটার একটি লাইন। স্যার , আমরা কথা দিচ্ছি আপনার সৃষ্টি একটি চরিত্রেরও জীবন ফুরাবেনা, তাদের কখনো করুনা ধারায় আসতে হবে না। তারা বেঁচে থাকবে ততদিন, যতদিন বেঁচে আছে মধ্যবিত্ত সমাজ, মধ্যবিত্ত পরিবার, মধ্যবিত্ত মানুষ। বাইরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে । ব্যাগের ভেতর রয়েছে প্রেমিকার দেয়া “নক্ষত্র বিলাস” বইটা। অনেক পড়েছি বইটা । আজ না হয় আবার।
প্রতিক্ষণ/এডি/সাদিয়া